নৌবহরে অত্যাধুনিক সাবমেরিন যুক্ত করছে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি-নেভি (প্ল্যান) বা নৌবাহিনী। পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরে পারমাণবিক সাবমেরিন দিয়ে প্রতিরক্ষা টহল বাড়াচ্ছে দেশটি। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রকেও চাপে পড়ে নতুন সামরিক সক্ষমতা অর্জন করতে হচ্ছে।
পেন্টাগনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, প্রথমবারের মতো চীন তার সমুদ্র উপকূলে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন মোতায়েন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর চাপ বাড়াতেই এটা করা হয়েছে। কারণ তারা চীনের সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।
পেন্টাগনের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চীনের ‘জিন’ শ্রেণির ছয়টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসমৃদ্ধ সাবমেরিনের বহর হাইনান দ্বীপ থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত টহল দিচ্ছে। হাইনান দ্বীপটি ‘চীনের হাওয়াই দ্বীপ’ নামে পরিচিত। এটি ইউলিন নৌ ঘাঁটির আবাসস্থল এবং এখানে প্ল্যানের সাবমেরিন রয়েছে।
রয়টার্স বলছে, অত্যাধুনিক দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরাসরি ‘যুক্তরাষ্ট্রের বুকে’ আঘাত হানতে সক্ষম। গত মার্চে কংগ্রেসে দেওয়া বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডের প্রধান জেনারেল অ্যান্টনি কটন বলেন, চীনা সাবমেরিনগুলো তৃতীয় প্রজন্মের ক্ষেপণাস্ত্র জেএল-৩ সজ্জিত।
চীনা ক্ষেপণাস্ত্র জেএল-৩ আনুমানিক ১০ হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত হানতে পারবে বলে পেন্টাগন জানিয়েছে। এগুলো চীনের উপকূলীয় জলসীমা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম।
রয়টার্স বলছে, অন্তত পাঁচজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও চারজন সমর বিশেষজ্ঞ সাবমেরিনগুলোকে চীনের সক্ষমতার ‘গুরুত্বপূর্ণ সূচক’ বলে মনে করেন। প্রতিবেদনে এই বিশেষজ্ঞদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
সামরিক বিশ্লেষকেরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, চীনা কৌশলবিদেরা আর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ঝুঁকিপূর্ণ টহল দেবে না। এর পরিবর্তে জেএল-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগরে সাবমেরিনগুলো প্রস্তুত রাখবে।
সুতরাং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে সজ্জিত এই সাবমেরিনগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হবে তাদের নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে।
চীনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসমৃদ্ধ সাবমেরিন
চীনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসমৃদ্ধ সাবমেরিন। ছবি: টুইটার
বলার অপেক্ষা রাখে না, চীনের দ্রুত অস্ত্র সক্ষমতা অর্জন নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ চীনের পাইপলাইনে আরও ছয়টি সাবমেরিন রয়েছে।
এর আগে ইউএস অফিস অব ন্যাভাল ইন্টেলিজেন্স (ওএনআই) বলেছিল, চীনের সাবমেরিন বহরে এখন ৬৬টি জাহাজ রয়েছে। তা বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৬টিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা চীনের রয়েছে।
দুই আপদের মুখে যুক্তরাষ্ট্র
পেন্টাগনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রসীমায় চীনা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের টহল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এটি ক্রমশ স্নায়ুযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ার নৌবাহিনীকে ঠেকাতেও যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রমাগত নজর রাখতে হচ্ছে। তাই দুই আপদের মুখে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্তত তিনজন বিশ্লেষক বলেছেন, রাশিয়া তার আর্কটিক উপকূলে কমপক্ষে ১১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন মোতায়েন রেখেছে। এটিও যুক্তরাষ্ট্রের দুর্ভাবনার কারণ।
দেশটির উত্তর কমান্ডের প্রধান জেনারেল গ্লেন ভ্যানহার্ক গত মাসে আর্মড সার্ভিসেস কমিটিকে বলেছেন, রাশিয়া আগামী দুই বছরের মধ্যে মার্কিন উপকূলে পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন দিয়ে অবিরাম টহল দেবে। রাশিয়া ইতিমধ্যে পারমাণবিক সাবমেরিনের মোতায়েন বাড়িয়েছে।
জেনারেল গ্লেন ভ্যানহার্ক আরও বলেন, শুধু আটলান্টিকে নয়, প্রশান্ত মহাসাগরেও তারা সাবমেরিন মোতায়েন করেছে। সুতরাং বিপদ আমাদের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর অনুসারে, গুয়াম ও হাওয়াইসহ প্রশান্ত মহাসাগরজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ২০টি পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন মোতায়েন রেখেছে। ২০২৭ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জাহাজগুলো পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করবে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন স্থাপনে সহায়তা করছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন স্থাপন করতে পারবে।
রাশিয়ার সাবমেরিন
রাশিয়ার সাবমেরিন। ছবি: উইকিপিডিয়া
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে চীন যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে তার সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, তা সত্যিই উদ্বেগের কারণ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্রমাগত চাপ
রয়টার্স জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে কথা হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার ইউএস নেভি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্কুলের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ টুমেইয়ের। তিনি বলেছেন, দ্রুততম সময়ে সমুদ্রসীমাগুলোতে যেভাবে টহল বাড়ছে, যেভাবে সবকিছু পরিবর্তিত হচ্ছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। সামনে কী পরিবর্তন অপেক্ষা করছে কে জানে!
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে চীন অবিশ্বাস্যভাবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসমৃদ্ধ সাবমেরিন পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করেছে, এটি অবিশ্বাস্য!
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ টিমোথি রাইট বলেন, মার্কিন বাহিনী সম্ভবত পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে। তবে আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে তাদের আরও পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রকে এখন দুটি পরমাণু শক্তিসমৃদ্ধ প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। একটি রাশিয়া, অপরটি চীন।
Leave a Reply