বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা বরাদ্দ আসে। এ টাকা স্বেচ্ছাসেবকদের না দিয়ে নামে-বেনামে তালিকা দেখিয়ে পকেটস্থ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ২৭ স্বেচ্ছাসেবকের তালিকা দেখিয়ে তাদের স্বাক্ষর জাল করে এ টাকা তুলে নেওয়া হয়।এক অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে দুর্নীতির এমন অভিযোগ অনুসন্ধানে টিকাদান কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা ও বরাদ্দের তথ্য চেয়ে গত ৫ মার্চ পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন এ প্রতিবেদক। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. মোস্তাফিজুর রহমান তথ্য দিতে গড়িমসি করেন। এরপর নতুন কর্মকর্তা ডা. মো. মাসুদ রানার কাছে তথ্য চাওয়া হলে তার দপ্তরে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই জানান।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনার টিকাদান কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবকের জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। ওই টাকা ২৭ স্বেচ্ছাসেবকের নাম দেখিয়ে ২০২২ সালের ৩০ জুন তুলে নেওয়া হয়। ওই ব্যয় ভাউচারটি পাস করেছেন হাসপাতালের তৎকালীন কর্মকর্তা ডা. মো. সাইফুল হাসান। এর পর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাস করিয়ে হাসপাতালের ক্যাশিয়ার আবুল বাশারের নামে ওই টাকা উত্তোলন করা হয়। বরাদ্দের টাকা উত্তোলন ও স্বেচ্ছাসেবকদের ওই তালিকাটি আমাদের হাতে এসেছে।
ওই তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- লিমন, মো. আল আমিন ও জুবায়ের নামে ৫৮ হাজার ৮০০ টাকা করে তোলা হয়েছে। ফাতিমা আক্তার রিমু, মাহমুদা, গোলাম রাব্বি, মোসা. সাবিনা, বাদল জোমাদ্দার, স্বপন তালুকদার, মো. সামিম, সাফিয়া বেগম, মো. সেলিম খান, মো. মাহি, সেবিকা রানি, আ. ছালামের নামে উত্তোলন করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা করে। সাইফুল ইসলাম, কনক রানী, শিকদার মো. কবির, সাদিয়া, ফিরোজা বেগম, আইয়ুব আলী, মো. আসিফ, আব. রহিম, নাজমা, মো. মারুফ, কহিনুর ও মনিরুল ইসলামের নামে ২৫ হাজার ২০০ টাকা করে তুলে নেওয়া হয়েছে। এভাবে মোট ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়।
স্বেচ্ছাসেবকদের ওই তালিকায় পাথরঘাটা যুব রেড ক্রিসেন্টের ১০ জন, সিপিপির ৪ জনের নাম রয়েছে। কিন্তু তাদের কাউকে কোনো টাকাই দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া তালিকায় থাকা বাকি ১৩ জনের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পাথরঘাটা যুব রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক রবিউল আলম সুজা, জুবায়ের ইসলাম, আল-আমিন, সাদিয়া, মোসা. সাবিনা, মো. শামিম বলেন, আমরা লেখাপড়ার পাশাপাশি মহামারী করোনাকালীন সরকারের টিকাদান কর্মসূচিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছি। হাসপাতাল থেকে আমাদের কোনো সম্মানী ভাতা দেওয়া হয়নি। এখন আমরা জানতে পারি, আমাদের নামে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা বরাদ্দ ছিল। সে টাকা আমাদের না দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের স্বাক্ষর জাল করে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। আমরা এ ঘটনার তদন্ত ও বিচার দাবি জানাচ্ছি।
পাথরঘাটা সিপিপির স্বেচ্ছাসেবক আ. রহিম, শিকদার মো. কবির, আইউব আলী, মাহমুদা বলেন, আমরা করোনাকালে পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সাত মাস কাজ করেছি। আমাদের কোনো ভাতা দেওয়া হয়নি। এখন আমরা জানতে পারছি আমাদের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সম্মানী ভাতা বরাদ্দ এসেছিল। আমরা দিনের পর দিন পরিশ্রম করে মানুষকে সেবা দিলেও আমাদের ভাতার টাকা হাসাপাতাল কর্তৃপক্ষ আত্মসাৎ করেছে। আমরা এ ঘটনার তদন্ত চাই এবং আমাদের প্রাপ্য সম্মানী ভাতার টাকা ফেরত চাই।
বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের সময় পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ছিলেন ডা. মো. সাইফুল হাসান। তিনি এখন বদলি হয়ে অনত্র চলে গেছেন। বরাদ্দের টাকা লোপাটের বিষয়ে সাইফুল হাসানের বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে তার মুঠোফোনে বক্তব্য জানতে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় পাথরঘাটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্তমান কর্মকর্তা ডা. মো. মাসুদ রানা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ইপিআই টেকনিশিয়ান লুৎফুন নেসার দাবি, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। ওই সময়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সাইফুল হাসানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি।
বরগুনা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ফজলুল হক বলেন, এ ঘটনায় আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান আমাদের সময়’কে বলেন, এ ঘটনায় কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
Leave a Reply