গত মার্চে মাদারীপুরের শিবচরে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় পড়ে ইমাদ পরিবহন। এই দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯ জন, আহত হন ২৬ জন। আর এই দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত প্রাণহানির জন্য অপরিকল্পিত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)।
আজ রোববার বুয়েট কাউন্সিল ভবনে এআরআই গবেষণা প্রতিবেদন দলের প্রধান গবেষক ড. শামসুল হক দীর্ঘ গবেষণা শেষে এক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করেন।
ড. শামসুল হক বলেন, ‘দুর্ঘটনা হয় বিশৃঙ্খলার জন্য। গতির জন্য দুর্ঘটনা হয় না যদি সুন্দর একটা শৃঙ্খল থাকে রাস্তায়। টানা গার্ড রেইল না থাকায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন করতে হবে। এটা থাকলে গাড়ি নিচে পড়ত না, ফলে প্রাণহানি কম হতো।’
গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৭ সালে আমদানি করা অশোক লিল্যান্ডের গাড়িটির ২০১৮ সালে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলেও ২০২২ এর শেষদিকে রুট পারমিট ও রেজিস্ট্রেশন স্থগিত ছিল।
প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে গাড়ির অতিরিক্ত গতি, চালকের বেপরোয়া চালানো, টায়ার ফেটে যাওয়া, বাস চালকের ক্লান্তি ও তন্দ্রাচ্ছন্ন, ব্রিজের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে যাওয়া এবং যান্ত্রিক/ব্রেকের ত্রুটি, মধ্যম শ্রেণির লাইসেন্স নিয়ে ড্রাইভিং, পথচারীকে আঘাত, আনফিট বাস এবং ভেজা রাস্তার কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে রাস্তা সংলগ্ন সার্ভিস রোডের অনুপস্থিতির কথা উল্লেখ করে নিরাপত্তার ঘাটতি নিয়ে ড. শামসুল বলেন, ‘ক্লিয়ার জোন বা মৃদু ঢাল না থাকা, রাস্তার অন্য প্রান্তের মতো দুর্ঘটনার প্রান্তে টানা গার্ড রেইল না থাকা, রাস্তা ও হার্ড শোল্ডারের মাঝে উচ্চতার অসামঞ্জস্য ব্যবধান এবং ব্রিজের প্রান্ত ও রাস্তার মাঝে উচ্চতার অসামঞ্জস্য ব্যবধান।’
সড়কের বিশৃঙ্খলার দূর করতে পরামর্শ দিয়ে ড. শামসুল হক বলেন, ‘উন্নত দেশে ট্রাক যদি তার লেন পরিবর্তন করে তাহলে পুলিশ ধরবে। ট্রাকের রুট বাম পাশে থাকলেও তারা ডান পাশে চলে আসে। ফলে ডান দিকে গিয়ে ওভারলেপিং করতে হয়। ওভারলেপিং করা যাবে না একই রুটে। এতে প্রতিযোগিতা হবে না ট্রিপ বেশি মারার জন্য। এতে চালকেরা প্রতিযোগিতায় নামবে না।’
প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বললেও আমাদের চিন্তা ভাবনা প্রাগৈতিহাসিক মন্তব্য করে অধ্যাপক শামসুল বলেন, ‘রাস্তা উঁচু করা হচ্ছে কিন্তু কোন রেলিং নেই। শুধু ব্রিজে ব্রিজে দেওয়া হচ্ছে। মনে হয় এই পানিতে পড়লেই ক্ষতি হবে। টানা রেলিং দিতে হবে।’
বিদেশ থেকে আসা সড়ক পরামর্শকের নিম্নমানের মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তারা দায়সারা কাজ করে যায়। হাইওয়ে বানালে সেফটি ব্যারিয়ার দিচ্ছে না। এখানে শুধু চালকের দোষ না। উন্নত দেশে ব্যারিয়ার না দিলে শাস্তি হয়।’ সড়কের নিরাপত্তা ঘাটতি সম্পর্কে ড. শামসুল বলেন, ‘অনুপযুক্ত স্থানে থামানো, এলোমেলো পথচারী পারাপার, ঢিলেঢালা মনিটরিং সিস্টেম।’
দুর্ঘটনার পরই মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি দুর্ঘটনার জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছে। ইমাদ পরিবহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স না থাকা, বেপরোয়া গতি ও বৃষ্টিতে মহাসড়কে পিচ্ছিল থাকা।
বুয়েটের প্রতিবেদন উপস্থাপনায় উপস্থিত ছিলেন ওই কমিটির সদস্য ও মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুজ্জামান ফকির। তিনি বলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে জমা দেওয়া তাদের প্রতিবেদন পূর্ণাঙ্গ ছিল না। এ ছাড়া কমিটির অধিকাংশ সদস্যই নন টেকনিক্যাল।’ ফলে ইমাদ পরিবহনের দুর্ঘটনা নিয়ে বুয়েটের এআরআই যে টেকনিক্যাল ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং উপস্থাপন করেছে সেটিকে তিনি যৌক্তিক মনে করেন।
গবেষণা দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন ড. আরমানা সাবিহা হক, শাহনেওয়াজ রাব্বি, ড. সোহেল মাহমুদ, নাজমুল হক, আসিফ রায়হান, মাহবুব তালুকদার, ইমরান উদ্দিন।
Leave a Reply