সাভারের রানা প্লাজা ধসের ১০ বছর আগামীকাল। দুঃসহ জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন আহত শ্রমিকরা। কাজ না পাওয়ায় আর্থিক কষ্টে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়েছে তাদের কাছে।
একদিকে চিকিৎসা ব্যয়, অন্যদিকে বেকারত্ব।
সবমিলিয়ে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে তাদের জীবন। শ্রমিক নেতারা বলছেন, পুনর্বাসনের কথা বার বার বলা হলেও তার বাস্তবায়ন এখনও নেই।
এদিকে রানা প্লাজার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার শুরু হলেও সাক্ষ্যগ্রহণই শেষ হয়নি ১০ বছরে। ৭ বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য ধর্না দিচ্ছেন সাভারের শ্রমিকরা। ১০ বছর আগে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক চাকরি পেতে বড় বাধা ‘রানা প্লাজার শ্রমিক’ পরিচয়।
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ২০০২ সালে এক তরুণী নীলফামারী থেকে ঢাকা আসেন। পরের বছর কাজ নেন রানা প্লাজার একটি গার্মেন্টসে। ২০১৩ সালের দুর্ঘটনায় তার ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেড় বছর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা। পঙ্গু এই শ্রমিককে কাজে নেয় না কেউ, কিন্তু প্রত্যেক মাসে তাকে কিনতে হয় কয়েক হাজার টাকার ওষুধ।
মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া প্রায় হাজারও শ্রমিকের পরিণতি এদের মতোই। জীবন-জীবিকার সন্ধানে কেউ সাভার ছেড়েছেন। কেউ মুছে ফেলেছেন রানা প্লাজার পরিচয়, আবার চাকরি না পেয়ে অনেকেই পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছেন। তাদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সমন্বয়ক তাসলিমা আক্তার জানান, সেদিনের ভবন ধসের ঘটনায় স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়েছেন ১৪শ শ্রমিক। এর পাশাপাশি মানসিক বিকলাঙ্গতা বা ট্রমার মধ্যে পড়েছে আরও অনেকেই।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ীদের বিচার শেষ হয়নি। ৮ বছর আগে বিচার শুরু হলেও শেষ হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ। এই নিয়ে ক্ষুব্ধ নিহতের পরিবারের সদস্যরা। এদিকে ভবন ধসের ঘটনায় হতাহত পরিবারের স্বজনরা বলছেন, আমাদের কেউ স্ত্রী, কেউ স্বামী বা পিতা-মাতা ও সন্তান হারিয়েছি। স্বজন হারানোর ব্যথা এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। আর পথ চেয়ে আছি বিচারের আশায়।
তাদের অভিযোগ, যাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অবহেলায় হাজার হাজার শ্রমিক হতাহত হয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে। আর প্রতীক্ষার অবসান হবে আমাদের।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় পরদিন সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যার অভিযোগে মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলায় অভিযোগপত্রে ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়। আসামি ৪১ জনের মধ্যে তিন আসামি মারা যান।
রোববার (২৩ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে রানা প্লাজার বেদীর সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিহতদের শ্রদ্ধা জানান ভুক্তভোগীরা। এ সময় নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে চারপাশ। নিহত শ্রমিকদের আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়ার আয়োজনও করা হয়। সময় উপস্থিতরা ২৪ এপ্রিলকে পোশাকশিল্পে শোকদিবস ঘোষণা, রানা প্লাজার সামনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের এক জীবনের ক্ষতিপূরণসহ ৪ দফা দাবি করেন।
ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রয়োজনীয় সহায়তা, পুনর্বাসন এবং আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, রানা প্লাজার দুর্ঘটনার দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। তাই দ্রুত সব ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক এবং তাদের পরিবারদেরকে সঠিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
তারা বলেন, রানা প্লাজা নামক ভবনটিতে শুধু রানার মালিকানাধীন কারখানাই ছিল না। এখানে আরও অনেক মালিকের কারখানা ছিল। কিন্তু সেইসব কারখানার মালিকরা কৌশলে সব দোষ রানার ওপর ফেলে দিয়েছে। এখন যদিও রানা কারাগারে, কিন্তু বাকি মালিকরা অনায়াসে দেশের বিভিন্ন স্থানে বহাল তবিয়তে কারখানা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই সবাইকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
মোমবাতি প্রজ্বলনে উপস্থিত ছিলেন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসমাইল হোসেন ঠান্ডু, বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি অরবিন্দ বেপারী, সাভার রানা প্লাজা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এমদাদুল ইসলাম।
Leave a Reply